উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ভিনদেশি আগাছা পার্থেনিয়াম

উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ভিনদেশি আগাছা পার্থেনিয়াম

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাস্তার দুই পাশে আমবাগান, ফসলের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়েছে ধনেপাতার মতো সবুজ পার্থেনিয়াম। প্রতিবেশী দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এ আগাছা জাতীয় গাছটি ছেয়ে গেছে পুরো রাজশাহী অঞ্চলে। আপাত দৃষ্টিতে নয়নাভিরাম মনে হলেও বিষাক্ত এ আগাছা ফসলের পরাগায়ন কমিয়ে দেয়। তাই এর বিস্তার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় আমবাগান রয়েছে ১২ হাজার ২১৮ হেক্টর জমিতে; যা পুরো রাজশাহী জেলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এসব বাগানে ছড়িয়ে পড়েছে পার্থেনিয়াম। এতে ফলন বিপর্যয় ঘটছে। এ ছাড়াও গ্রামীণ সড়ক, কৃষিজমি, বাড়ির আঙিনায়ও দেখা যাচ্ছে গাছটি। এরই মধ্যে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ফসলে; যা উদ্বেগ ছড়াচ্ছে কৃষকের মনে।

গত বছর বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকার তারিকুল ইসলাম দেড় বিঘা জমিতে কাটিমন জাতের বারোমাসি আমের বাগান করেছিলেন। দুই-তিন মাস পরেই দেখেন পুরো বাগান ধনে পাতার মতো সবুজ গাছে ছেয়ে গেছে। দেখতে সুন্দর হওয়ায় গাছগুলো নষ্ট করেননি। লক্ষ্য করেন, গাছে মুকুল এলেও আম থাকে না। কৃষিবিদ এসে গাছগুলোকে নষ্ট করার পরামর্শ দেন। এ বছর আম এসেছে।

সবজি চাষি চারঘাটের ঝিকড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম জানতেন না পার্থেনিয়াম বিশাক্ত আগাছা। তাই জমি থেকে তুলে ছাগলকেও খাইয়েছেন। তাঁর ক্ষেতে ফুল এলেও ফল হচ্ছে না। গমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কৃষি কর্মকর্তাকে জানালে তিনি আগাছা পরিষ্কারের পরামর্শ দেন। কিন্তু এর পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে, তুলে ফেললে ক’দিন পরে আবারও হচ্ছে। এখন তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।

চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, আমরা কৃষকদের এই আগাছা পুড়িয়ে ফেলতে কিংবা মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছি। এ ছাড়া পার্থেনিয়ামে ফুল আসার আগে গ্লাইফোসেট নামক আগাছানাশক প্রতি লিটার পানিতে ১০-১৫ মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করলেও এ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।

মানুষ বা গবাদিপশুও পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এ গাছের সংস্পর্শে এলে প্রথমে চুলকানি হয়। এর রেণু নাকে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমাসহ জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এ আগাছা ধ্বংস করা উচিত বলে মনে করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আশিকুর রহমান।

চারঘাটের রাওথা এলাকার রবিউল ইসলাম জানান, তাঁর ৯ বছর বয়সী মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে পার্থেনিয়াম গাছ তুলে আনে। এরপর থেকেই তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে লাল দাগ ও চুলকানি হয়। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখালে পার্থেনিয়াম থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শ দেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সরকার এনায়েত কবিরের ভাষ্য, গবাদিপশুর জন্যও এ আগাছা ক্ষতিকর। উদ্ভিদটি দ্রুত বাড়ে এবং হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এজন্য অনেক চাষি ছাগল-গরুকে খেতে দেয়। পরক্ষণেই মুখে ও মাড়িতে ঘা, ডায়রিয়াসহ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়।

দেড় দশক আগেও দেশে পার্থেনিয়ামের অস্তিত্ব ছিল না। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ অ্যাডকিনস যশোর অঞ্চলে আগাছাটির উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত করেন। ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা অন্তত ৩৫টি জেলার ধানক্ষেত ছাড়া সব ধরনের ফসলের ক্ষেতেই পার্থেনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর উচ্চতা দুই-তিন ফুট, আয়ুষ্কাল তিন-চার মাস। চিকন সবুজ পাতার ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুল আর ত্রিভুজের মতো ছড়িয়ে থাকে অসংখ্য শাখা। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি এ পরগাছা দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন এলাকায়।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোর আঞ্চলিক কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন ২০১১-২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় পার্থেনিয়াম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, একটি পার্থেনিয়াম থেকে ৬০ হাজার গাছের জন্ম হতে পারে। আশপাশের দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাতাসের সাহায্যে এর বীজ ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাজশাহী ও যশোর এলাকায় এ আগাছার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এটি মানুষ, গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া ফসলের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। ফলে এর বিস্তার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাক বা গরু-মহিষের বিষ্ঠার সঙ্গে হয়তো এর বীজ চলে এসেছে। রাজশাহীর চারঘাট-বাঘাসহ বিভিন্ন এলাকায় খুব দ্রুত এই আগাছা ছড়িয়ে পড়েছে। ফসল ও পরিবেশ রক্ষায় এ আগাছা নিধনে আমাদের সবারই কাজ করা উচিত।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )