
সনি আজাদঃ চারঘাটের পশ্চিম বালাদিয়াড় এলাকা। স্থানীয় মাজেদুল ইসলাম, জাকিরুল ইসলাম, শওকত আলীসহ একাধিক ব্যক্তি বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ক্রিম ও প্রসাধনীর কৌটা তৈরি করছিলেন। স্থানীয় অনেকের অভিযোগ, এর পাশাপাশি নকল পণ্যও তৈরি করা হয়। তবে মাজেদুল ইসলামের ভাষ্য, ‘আমরা শুধু কৌটা তৈরি করি। প্রশাসন বারবার অভিযান চালিয়েও প্রসাধনী তৈরির প্রমাণ পায়নি। এসব আমরা ছোট কোম্পানিতে সরবরাহ করি।’
চারঘাটের বালাদিয়াড় ও মুংলি, পুঠিয়ার সদর ও বানেশ্বর এবং বাঘার আড়ানী এলাকায় এ ধরনের ৩০টির অধিক প্রসাধনী ও কৌটা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কয়েকটি আইনের জাল থেকে বাঁচতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে দু-একটি পণ্যের জন্য বিএসটিআইর লাইসেন্স নিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এর আড়ালে নামি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি করা হয় অনেক কারখানায়। সীমান্তবর্তী এ তিন উপজেলার পাড়াগাঁয়ে তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়।
নকল প্রসাধনীতে ছেয়ে গেছে বিপণিবিতান থেকে পাড়া-মহল্লার দোকানও। এসব তৈরি ও বাজারজাতের অভিযোগে তিন উপজেলায় অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে জরিমানা বা লঘু দণ্ডে পার পেয়েছে তারা।
রাজশাহীতে ভেজাল ক্রিম কারখানা নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব ফরিদ আহম্মদ স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা জারি করেন জেলা প্রশাসক। পুঠিয়া ও চারঘাটের ইউএনও বরাবর সেটি পাঠানো হয়। দুই ইউএনও জানান, এতে ১৪টি কারখানার কথা উল্লেখ ছিল। পত্রে উল্লেখ করা হয়, কারখানার মালিকরা দু-একটি পণ্য উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী তৈরি করে গোপনে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করছে। বহুজাতিক কোম্পানির নামে নকল পণ্য তৈরিরও অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নকল প্রসাধনীতে মেইড ইন জার্মানির জায়গায় মেইড অ্যাজ জার্মান, ইউনিলিভারের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির আদলে ফেজার অ্যান্ড লাভলি, ফুয়ার অ্যান্ড লাভলির মতো নাম ব্যবহার হচ্ছে। হারবাল পণ্যের নামে রং ফর্সাকারী ক্রিমও তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অনেক নামি ব্র্যান্ডের নামে নকল পণ্য রাজধানীর চকবাজার থেকে এনে এসব কারখানায় প্যাকেটজাত করা হয়। এতে ব্যবহার করা হয় প্রকৃত প্রতিষ্ঠানের নাম, অনুমোদন, বিএসটিআইর লোগো, ব্যাচ নম্বর, এমআরপি, মেয়াদের তারিখসহ অন্যান্য তথ্য। ভালোভাবে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, কোনটা আসল আর কোনটা নকল।
বাঘার আড়ানী এলাকার আব্দুল মতিনের ছেলের বয়স সাত মাস। স্থানীয় বাজার থেকে বেবি পাউডার কিনে রাতে তার শরীরে দেন। পরদিন তার পুরো শরীর লাল হয়ে বমি করা শুরু করে। পরে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, পাউডার থেকে ছেলে আক্রান্ত হয়েছে। জনসনের পণ্য চাইলেও দোকানির দেওয়া পাউডারে লেখা ছিল জনসন প্লাস। তিনি বলেন, ‘কেনার সময় বিষয়টি খেয়াল করিনি।’
গত বছর পুঠিয়ার রামজীবনপুর গ্রামে কাফি কসমেটিক্স নামের প্রতিষ্ঠান নকল প্রসাধনী তৈরি করছিল। সেখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে মেইড ইন পাকিস্তান লেখা পণ্যের লেভেল মার্ক উদ্ধার করে। ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হলেও তা পরিশোধ করে একইভাবে প্রসাধনী তৈরি করছে বলে জানা গেছে।
র্যাবের সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল পুঠিয়ার পালোপাড়ার নকল প্রসাধনী কারখানায় অভিযান চালিয়ে ক্রিম তৈরির লেভেল, কেমিক্যাল ও উপকরণ জব্দ করে। পরে তিনজনকে দণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত বছরের নভেম্বরে চারঘাটের ভাটপাড়ায় মায়া গোল্ড নামে কারখানায় অভিযান চালিয়ে মেইড ইন ইন্ডিয়া লেখা পণ্য তৈরির সময় হাতেনাতে আটক করে একজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে মালিক আরিফুল ইসলাম স্থান পরিবর্তন করে একই কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তিনি তা অস্বীকার করেছেন। কারখানা পরিদর্শন করতে দিতেও রাজি হননি।
চারঘাট ও পুঠিয়া কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে থাকা ভারতীয় প্রসাধনীর ৮০ ভাগই পরিবেশকরা আমদানি করেন না। সীমান্ত পেরিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে আসা এসব পণ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানির ১২৫ গ্রামের একটি ফেস প্যাকের টিউবের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা ছিল ১৬০ রুপি। তবে বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়। একই কোম্পানির অন্তত ৩০টি পণ্য রয়েছে বাজারে। একটিতেও আমদানিকারকের সিল নেই। আরেকটি কোম্পানির বডি স্প্রেতে কাগজের সিলে দাম লেখা ৫৪০ টাকা। তবে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। শিশু প্রসাধনী, সুগন্ধিসহ অনেক দামি ব্র্যান্ডের পণ্যেও একই অবস্থা দেখা গেছে।
ভ্যানে করে দামি ব্র্যান্ডের পণ্য কম দামে পাইকাররা দিয়ে যান বলে জানান পুঠিয়ার প্রসাধনী ব্যবসায়ী মজিবর রহমান। তাঁর ভাষ্য, অনেকে বেশি লাভের আশায় সেগুলো কিনে বিক্রি করেন। এসব পণ্য দেখতে কিংবা ঘ্রাণে আসলের কাছাকাছি। কিন্তু ফলাফলে অনেক তফাৎ। দাম কম হওয়ায় আসল পণ্যের চেয়ে এসবের চাহিদা বেশি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত থেকে চোরাইপথে কিছু পণ্য কালোবাজারে নিয়ে আসেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। কিছু বিউটি পার্লারে এগুলো ব্যবহার হয়। তবে বেশির ভাগই ঢাকায় তৈরি নকল পণ্য। এর কৌটা ও লেবেল এনে স্থানীয়ভাবে প্যাকেটজাত করা হয়। এ জন্য দোকানে বিভিন্ন দামে পাওয়া যাচ্ছে।
এসব পণ্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিউটিশিয়ান শারমিন সুলতানা বলেন, অনেকে মুখে কালো দাগ, রেশ, গোটা, অ্যালার্জির সমস্যা নিয়ে আসেন। জানতে চাইলে তারা ক্রিম, ফেসওয়াশ ও লোশন ব্যবহারের কথা বলেন। পরে তাদের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আশিকুর রহমান বলেন, নকল প্রসাধনীর কারণে অ্যালার্জিসহ বিভিন্ন ধরনের ডারমাটাইসিস, ক্ষত, চামড়া কালো, একজিমাসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অধিক কেমিক্যাল দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, পুঠিয়া ও চারঘাটে নকল প্রসাধনী কারখানায় অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। জেল-জরিমানা করলেও তারা স্থান পরিবর্তন করে ফের একই কাজ করে। তবে এসবের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চলমান আছে।